স্পোর্টস ডেস্ক: ২০১৯ চলে যায়। সঙ্গে নিয়ে যায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাকিবময় একটি ঘটনাবহুল বছর। বলা যায়, এক সাকিবে গর্বিত আবার সাকিবেই নিন্দিত এক বছর যেখানে দেশের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। তার কারণে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপের মঞ্চে উদ্ভাসিত বাংলাদেশ। তার ফ্র্যাঞ্চাইজি বদলের সূত্র ধরে কিছু পরেই বিপিএলের চরিত্র অন্তত একটি বছরের জন্য পাল্টে যাওয়া। এরপর খেলোয়াড় ধর্মঘট ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আরও আলোচিত। এবং সেটা শেষ না হতেই ভূপাত ধরণীতল। জুয়াড়ির সঙ্গে এক বছর ধরে থাকা যোগাযোগের তিনটি ঘটনা গোপন করায় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থার নেমে আসা নিষেধাজ্ঞায় সব ধরনের ক্রিকেটে সাকিব ব্রাত্য। এক বছরের স্থগিতাদেশসহ ২ বছরের নিষেধাজ্ঞা।
সব মিলে সাকিব রোমাঞ্চে রোমাঞ্চিত বাংলাদেশের ক্রিকেটের পরিচালনা সংস্থা বিসিবিকেও পার হতে হয়েছে বেশ কঠিন এক বছর। জাতীয় দল থেকে ঘরোয়া লিগ বা ফ্র্যাঞ্চাইজি আসর অথবা বোর্ড পরিচালকের কেলেঙ্কারি মিলিয়ে সামলাতে হয়েছে ম্যালা হ্যাপা।
২০১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার টার্গেট নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। দল হিসেবে মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার দল খেলতে ব্যর্থ। ৮ ম্যাচের মোটে ৩টি জয়। ফর্মহীন নেতা সমালোচিত। শেষে এক ম্যাচে তার বদলে সাকিবের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা সামলে নিয়েছিলেন মাশরাফী। সব ম্যাচ খেলে তার মাত্র ১ উইকেটের উল্টোপিঠে তখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি ও টেস্টের অধিনায়ক সাকিব গোটা বিশ্ব আলোকিত করেছেন একা হাতে। বাঁহাতি ব্যাটিং ও স্পিনে অল রাউন্ডারের নতুন রেকর্ড গড়েছেন বিশ্বকাপে। সেরাদের সেরা গড়ে (৮৬.৫৭) ৮ ইনিংসে ২ সেঞ্চুরি ও ৫ ফিফটির সঙ্গে ১১ উইকেট রীতিমতো সুপারম্যানের উচ্চতায় নিয়ে যায় সাকিবকে। বাংলাদেশের দলগত বাজে পারফরম্যান্সের অনেকটা আড়াল করেছিল সাকিবের এই আসুরিক পারফরম্যান্স।
বিশ্বকাপ খেলেই কিছুদিনের বিশ্রামে যান সাকিব। মাশরাফী চোটে পড়েন শ্রীলঙ্কা সফরে যাওয়ার ঠিক আগের বিকেলে। বিশ্বকাপে গড়পড়তা পারফরম্যান্সে প্রবল চাপে থাকা তামিম ইকবাল শ্রীলঙ্কায় ৩ ওয়ানডের সিরিজে নেতৃত্ব দিলেন। হোয়াইটওয়াশ হওয়ার সঙ্গে নিজের ফর্ম আরও হারিয়ে ফেলায় তামিম বেশ কিছুদিনের জন্য খেলা থেকে বিশ্রামে গেলেন। সাকিবের নেতৃত্বে এরপর আফগানিস্তান-জিম্বাবুয়েকে নিয়ে ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়ে কিছুটা মান বাঁচায় বাংলাদেশ।
কিন্তু সাকিবের তো এই বছরের সবকিছুতে থাকার কথা! নিয়তি নির্ধারিত! বছরের ৫ টেস্টের ৪টিতেই ইনিংস ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ। চোট ও নিষেধাজ্ঞার কারণে এর মধ্যে মোটে একটিতে নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন সাকিব। টেস্টে নবাগত আফগানিস্তানের বিপক্ষে অল স্পিন আক্রমণ নিয়ে ২২৪ রানে হেরে বসায় বাংলাদেশকে পড়তে হলো লজ্জায়। সাকিব কোনো পেসার খেলাতে রাজি হননি।
এরপর ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে সাকিব চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরলেন বার্বাডোজ ট্রাইডেন্টে খেলে। তিনি ফিরতে না ফিরতে বাংলাদেশের ক্রিকেটে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। এক দুপুরে সাকিব ঘোষণা দিলেন, ১১ দফা দাবিতে ক্রিকেটাররা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটে যাচ্ছেন। প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভারত সফরের তখন মোটে দুই সপ্তাহ বাকি।
ওখানে দেশের শীর্ষ সব ক্রিকেটারের নেতা হিসেবে সাকিব নিজেকে প্রমাণ করে দেন। দিন দুয়েকের মধ্যে বিসিবি খেলোয়াড়দের ডেকে বেশিরভাগ দাবি মেনে নিয়ে এবং বাকি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ঝামেলা মেটায়।
কিন্তু ২৯ অক্টোবর বোমা বিস্ফোরণ। দুর্নীতির তিনটি চার্জ এনে সাকিব অন্তত ১২ মাসের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যান। অশ্রুসিক্ত অল রাউন্ডার ক্ষমা চেয়ে আরও শক্তভাবে ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান।
টানা দুই ধাক্কায় টালমাটাল বাংলাদেশের ভারত সফর শুরু হতে তখন দুদিন বাকি। মুমিনুল হককে টেস্ট আর মাহমুদউল্লাহকে টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক করে ভারত পাঠানো হয়। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো তিন সংস্করণে তিন অধিনায়কের অধ্যায়ে পা রাখে।
নভেম্বরের শুরুতে অবশ্য পেছনের সব নেতিবাচক ঝামেলা এক ঝটকায় বাংলাদেশ দল গা থেকে ছিটকে ফেলে। দিল্লিতে ৩ ম্যাচের সিরিজের প্রথমটিতে ভারতকে হারিয়ে লিড নিয়ে ক্রিকেট দুনিয়া কাঁপান মুশফিকুর রহিমরা। ভারতের মাটিতে প্রথম জয়ের ইতিহাস। পরে সিরিজ ২-১ এ হারলেও এটা ছিল দারুণ স্বস্তির।
বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর ইংলিশ কোচ স্টিভ রোডসের সঙ্গে চুক্তি আর বাড়ায়নি বাংলাদেশ। দক্ষিণ আফ্রিকান হাই প্রোফাইল কোচিং দল গড়ে ওঠে। প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো, ব্যাটিং কোচ নিল ম্যাকেঞ্জি, ফাস্ট বোলিং কোচ শার্ল ল্যাঙ্গাভেল্ট, ফিল্ডিং কোচ রায়ান কুক, ফিজিও জুলিয়ান কালেফাতোর সঙ্গে নিউজিল্যান্ডার স্পিন বোলিং কোচ ড্যানিয়েল ভেট্টোরি ও লঙ্কান ট্রেনার মারিও ভিল্লাভারায়ন। দুর্ধর্ষ এই দল থেকে অবশ্য বছরের শেষটায় ল্যাঙ্গাভেল্ট মুক্তি নিয়েছেন। দেশের বোলিং কোচ হয়েছেন। তবু শক্তিশালী স্টাফ।
ডমিঙ্গো কিছু বুঝে ওঠার আগে আফগানদের কাছে হার, বুঝতে বুঝতে ভারতের মাটিতে পা রেখে কত কিছু না দেখে ফেলা। ইন্দোরে ভারতের বিপক্ষে শোচনীয় হারের পর কলকাতায় পা রেখে আরও লজ্জা। গোলাপি বলে উপমহাদেশে প্রথম টেস্ট, ইডেন গার্ডেনসে। সেখানে দুদিন আর ঘণ্টাখানেকে শোচনীয় হার। দিবারাত্রির টেস্টে দুই ব্যাটসম্যান আবার মাথায় আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়ায় লেগেছে বদলি দুজন।
৫ টেস্টের প্রতিটিতে লজ্জা। ওয়ানডেতে অনেক ভালো বাংলাদেশের বেশ পতন হয়েছে বছরটাতে। ১৮ ম্যাচের মোটে ৭টিতে জয়। তবে আয়ারল্যান্ডে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ফাইনালে হারিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে মিলিয়ে প্রথম বহুজাতিক সিরিজ জয় উল্লেখ্য। ওদিকে সবচেয়ে খারাপ যেটিতে সেই টি-টোয়েন্টির ৭ ম্যাচের ৪টিতে জয় পরিসংখ্যান হিসেবে খারাপ না। আছে সাকিবের নেতৃত্বে ত্রিদেশীয় সিরিজে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হওয়াও।
মেয়েরা উঠে আসছেন। ২০২০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে এবার তারা চ্যাম্পিয়ন। এরপর এসএ গেমসেও জিতেছে শিরোপা।
পুরুষদের ক্রিকেটে মুশফিকের ধারাবাহিকতা ছাড়া ব্যাটিং-বোলিংয়ে ধারাবাহিক আর কেউ নন। বিশ্বকাপও ভালো ছিল। টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতেও নির্ভরযোগ্য। আসলে এই বছরটাতে দল হিসেবে ভেঙে পড়েছে বাংলাদেশ। টিম কম্বিনেশন বলে কিছু বাকি নেই আর।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে শেষ হচ্ছে বছর, এই ভূখণ্ডের ক্রিকেট নতুন বছরে পা রাখবে এ লিগ দিয়েই। এর মধ্যে আইপিএলের নিলাম শেষ। প্রথমবারের মতো সেখানে কোনো বাংলাদেশি নেই। সাকিব থাকলে একমাত্র হতেন। বিপিএল এবার ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক নয়, বিসিবির ব্যবস্থাপনায় স্পন্সরভিত্তিক। ঢাকা ডায়নামাইটস থেকে রংপুর রাইডার্সে নাম লিখিয়েছিলেন সাকিব। আচমকা বিষয়টা আসে। জানা যায়, ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সঙ্গে চুক্তি শেষ। এক বছরে দুটি বিপিএলের খরচ সব ফ্র্যাঞ্চাইজি সামলাতে চায়নি। বিসিবি শেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী সামনে রেখে তার নামে আয়োজন করেছে বিশেষ বিপিএল। সেখানে না থেকেও দিনশেষে কোনো না কোনোভাবে আলোচনায় সাকিব।